এর্নেস্তো "'চে" গেভারা ছিলেন একজন
আর্জেন্টিনীয় মার্কসবাদী, বিপ্লবী, চিকিত্সক,
লেখক, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ,
সামরিক তত্ত্ববিদ এবং কিউবার বিপ্লবের
প্রধান ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল
এর্নেস্তো গেভারা দে লা সের্না।
তবে তিনি সারা বিশ্ব লা চে বা কেবলমাত্র
চে নামেই পরিচিত। মৃত্যুর পর তাঁর শৈল্পিক
মুখচিত্রটি একটি সর্বজনীন প্রতিসাংস্কৃতিক
প্রতীক এবং এক জনপ্রিয় সংস্কৃতির
বিশ্বপ্রতীকে পরিণত হয়।
তরুণ বয়সে ডাক্তারি ছাত্র হিসেবে চে সমগ্র
লাতিন আমেরিকা ভ্রমণ করেছিলেন। এই সময় এই
সব অঞ্চলের সর্বব্যাপী দারিদ্র্য তাঁর মনে গভীর
রেখাপাত করে। এই ভ্রমণকালে তাঁর অর্জিত
অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে তিনি এই
সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে এই অঞ্চলে বদ্ধমূল
অর্থনৈতিক বৈষম্যের স্বাভাবিক কারণ হল
একচেটিয়া পুঁজিবাদ, নব্য ঔপনিবেশিকতাবাদ ও
সাম্রাজ্যবাদ; এবং এর একমাত্র সমাধান হল
বিশ্ব বিপ্লব। এই বিশ্বাসের
বশবর্তী হয়ে চে রাষ্ট্রপতি জাকোবো আরবেনজ
গুজমানের নেতৃত্বাধীন গুয়াতেমালার সামাজিক
সংস্কার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৪
সালে সিআইএ-এর
ষড়যন্ত্রে গুজমানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলে চে-র
বৈপ্লবিক আদর্শ চেতনা বদ্ধমূল হয়।
পরবর্তীকালে মেক্সিকো সিটিতে বসবাসের
সময় তাঁর সঙ্গে রাউল ও ফিদেল কাস্ত্রোর
আলাপ হয়। চে তাঁদের ছাব্বিশে জুলাই
আন্দোলনে যোগ দেন। মার্কিন-মদতপুষ্ট কিউবান
একনায়ক ফুলজেনসিও বাতিস্তাকে উৎখাত করার
জন্য গ্রানমায় চড়ে সমুদ্রপথে কিউবায় প্রবেশ
করেন। অনতিবিলম্বেই চে বিপ্লবী সংঘের এক
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।
সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড পদে তাঁর পদোন্নতি হয়
এবং বাতিস্তা সরকারকে উত্খাত করার
লক্ষ্যে দুই বছর ধরে চলা গেরিলা সংগ্রামের
সাফল্যের ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করেন।
কিউবার বিপ্লবের পর চে নতুন সরকারে একাধিক
ভূমিকা পালন করেছিলেন। এগুলির
মধ্যে উল্লেখযোগ্য,
বিপ্লবী আদালতে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত
আপিল পুনর্বিবেচনা ও
ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড প্রদান,
শিল্পোদ্যোগ মন্ত্রী হিসেবে খামার সংস্কার
আইন প্রবর্তন, কিউবার জাতীয় ব্যাংকের
প্রেসিডেন্ট ও সামরিক বাহিনীর
ইনস্ট্রাকশনাল ডিরেক্টরের ভূমিকা পালন,
এবং কিউবান সমাজতন্ত্রের
প্রচারে বিশ্বপর্যটন। এই পদাধিকারের
কল্যাণে তিনি মিলিশিয়া বাহিনীকে প্রশিক্ষণ
প্রদানের সুযোগ পান; ফলত এই বাহিনী পিগ
উপসাগর আক্রমণ করে তা পুনর্দখলে সক্ষম হয়।
কিউবায় সোভিয়েত পরমাণু ব্যালিস্টিক
মিসাইল আনার ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করেছিলেন। চে ছিলেন এক
বিশিষ্ট লেখক ও ডায়েরি-লেখক।
গেরিলা যুদ্ধের উপর
তিনি একটি প্রভাবশালী ম্যানুয়েল রচনা করেন।
তরুণ বয়সে দক্ষিণ আফ্রিকায়
মোটরসাইকেলে ভ্রমণের স্মৃতিকথাটিও তাঁর
অত্যন্ত জনপ্রিয় রচনা। বৃহত্তর বিপ্লবে অংশ
নেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৬৫
সালে কিউবা ত্যাগ করেন। প্রথমে কঙ্গো-
কিনসহাসায় তাঁর বিপ্লব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
এরপর তিনি বলিভিয়ায় বিপ্লবে অংশ নেন।
এখানেই সিআইএ-মদতপুষ্ট বলিভিয়ান
সেনা হাতে বন্দী ও নিহত হন চে।
ফিদেল কাস্ত্রোকে লেখা চে’র শেষ চিঠি
ফিদেল,
এ মুহূর্তে অনেক কিছুই মনে পড়ছে আমার।
মারিয়া অ্যান্তোনিয়র বাসায় যেদিন আপনার
সাথে দেখা হলো, যখন আপনি আহবান
জানালেন বিপ্লবের প্রস্তুতির সাথে জড়িত
সকল উত্তেজনায় আমিও যেন অংশ নেই। একদিন
কারা যেন জানতে চাইলো আমাদের মৃত্যুর
সংবাদ কাকে আগে অবহিত করতে হবে,
এবং ঘটনাটার বাস্তবিক সম্ভাবনা আমাদের
সবাইকে বিচলিত করে তুললো।
পরে আমরা জেনেছি বিপ্লবের
ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সত্য হলো কেউ
জিতবে নতুবা মৃত্যুবরণ করবে (যদি তা হয় প্রকৃত
বিপ্লব)।
এভাবেই বিজয়ের যাত্রাপথে শহীদ হন অগণিত
কমরেড। সবকিছুতেই নাটকীয়তার সেই স্বর আজ
অনেক বেশি পরিণত। কিউবার বিপ্লবের
প্রতি যে কর্তব্যবোধ আমাকে এর সঙ্গে যুক্ত
করেছিল, আমি অনুভব করছি, সে দায়িত্ব
আমি সম্পন্ন করতে পেরেছি, এবং আমি বিদায়
জানাচ্ছি আপনাকে, কমরেডদের, আপনার
জনগণকে যারা এখন আমারও।
আমি আনুষ্ঠানিকভাবে পার্টির নেতৃত্ব, মন্ত্রীর
পদ, কমান্ডারের পদমর্যাদা এবং কিউবার
নাগরিকত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে আনছি।
আইনগত আর কিছুই কিউবার
সঙ্গে আমাকে সম্পর্কযুক্ত করবে না। অবশিষ্ট
যে বন্ধনটুকু থাকবে তা ভিন্ন চরিত্রের,
কোনোভাবেই তাকে ভেঙে ফেলা যায় না,
যেকোনো নিয়োগচুক্তিকে খুব সহজেই
যেভাবে ভাঙা যায়। অতীতের
দিকে তাকিয়ে আমি বিশ্বাস করি বৈপ্লবিক
বিজয়কে সুসংহত করার জন্য প্রয়োজনীয়
সততা এবং যথাযথ নিষ্ঠা নিয়েই আমি কাজ
করেছি।
আমার একমাত্র ব্যর্থতা সিয়েরা মায়েস্ত্রার
প্রথম সময়গুলোয় আপনার প্রতি আমার আস্থার
অভাব, এবং নেতা ও বিপ্লবী হিসেবে আপনার
যোগ্যতাকে দ্রুত উপলব্ধি করতে পারার অক্ষমতা।
এখানে আমি দুর্দান্ত কিছু সময় কাটিয়েছি,
যুগপৎ দীপ্ত ও ক্যারিবীয় সংকটের ঝাপটায়
বিমর্ষ দিনগুলোয় জনগণের সঙ্গী হওয়ার গৌরবও
অর্জন করতে পেরেছি। সেই সময়গুলোয় আপনার
চেয়ে মণীষাপূর্ণ নেতৃত্ব দেওয়া খুব কম
রাষ্ট্রনায়কের পক্ষেই সম্ভব হতো। কোনো রকম
দ্বিধা ছাড়াই আমি যে আপনাকে অনুসরণ
করেছি, আপনার ভাবার, দেখার এবং বিপদ ও
নীতির মূল্যবোধের প্রক্রিয়ার
প্রতি আমি যে একাত্ম হতে পেরেছি, এ জন্য
আমি গর্ববোধ করি। পৃথিবীর অন্য
জাতিগুলো আমার ঐকান্তিক সংগ্রামের পথ
চেয়ে আছে। তাদের ডাকেই আমি সাড়া দিচ্ছি,
যদিও কিউবার রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার কারণে এ
কাজে অংশ নেওয়া আপনার পক্ষে এ
মুহূর্তে সম্ভব নয়। আমাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময়
তাই এসে গেছে। এ কথা আমি জানাতে চাই, এই
বিচ্ছেদ একই সঙ্গে আমার জন্য আনন্দ ও
বিষাদের। একজন নির্মাতা হিসেবে এই
রাষ্ট্রের প্রতি আমি রেখে যাচ্ছি আমার
বিশুদ্ধতম প্রত্যাশা এবং আমার সবচেয়ে প্রিয়
মানুষের একজনকে, এবং এমন একজন
মানুষকে যিনি আমাকে সন্তান হিসেবে গ্রহণ
করেছিলেন। এটা আমার আত্মার
একটা অংশকে বিক্ষত করছে। নতুন
যুদ্ধক্ষেত্রে আমি সেই বিশ্বাসটুকুকেই
সঙ্গী করে দাঁড়াবো যা আপনি আমার ভেতর
বুনে দিয়েছেন, সঙ্গে থাকবে পবিত্রতম কর্তব্য
পালনের সুখানুভূতি; এই সবকিছু দিয়েই
আমি লড়বো সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, যেখানেই
সে থাকুকনা কেনো। এ ব্যাপারটাই
আমাকে স্বস্তি দিচ্ছে আর
শুশ্রুষা করছে অন্তরের গভীরতম ক্ষতকে।
আরেকবার বলতে চাই, সব রকমের দায়দায়িত্ব
থেকে কিউবাকে মুক্ত করে দিচ্ছি আমি, তবে এই
রাষ্ট্রের উদাহরণ তার কাঁধে যে দায়িত্ব
চাপাবে তা থেকে নয়। যদি আমার শেষ
মুহূর্তগুলো আমাকে আবিস্কার
করে অন্যকোনো আকাশের নিচে, তবু আমার শেষ
ভাবনাগুলো এদেশের মানুষদের ঘিরেই থাকবে,
বিশেষত আপনাকে। আমি আপনার
শিক্ষা এবং দৃষ্টান্তের জন্য আপনার
প্রতি কৃতজ্ঞ, এবং আমি আমার সংগ্রামের
চুড়ান্ত পরিণতি পর্যন্ত চেষ্টা করবো আপনার
প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে। আমাদের বিপ্লবেরর
বিদেশনীতির প্রতি আমি সবসময় একাত্ম ছিলাম
সামনেও থাকবো। যেখানেই থাকি আমি, একজন
কিউবান বিপ্লবীর কর্তব্যবোধ আমার
মধ্যে থাকবে, এবং সে অনুসারেই আমি কাজ
করে যাবো।
এ বিষয়ে আমার তিলমাত্র লজ্জা নেই যে,
আমার স্ত্রী এবং সন্তানদের জন্য বৈষয়িক
কোনো কিছুই রেখে যেতে পারলাম না;
আমি সুখী এটাই সে রাস্তা। তাদের জন্য
অতিরিক্ত কিছুই আমি চাই না, কারণ জীবনধারণ
আর শিক্ষা গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রই যথেষ্ট
দেবে তাদের। আপনাকে এবং আমাদের
জনগণকে অনেক কিছুই আমি বলতে পারতাম,
কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তার কোনো প্রয়োজন
নেই। শব্দের
কাছে আমি যা প্রত্যাশা করি তা প্রকাশের
সামর্থ্য তার নেই, এবং এও আমার মনে হয়
না যে, লিখে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ভরিয়ে তোলার
কোনো মানে আছে। আমার সমস্ত
বিপ্লবী স্পৃহা দিয়ে আপনাদের আলিঙ্গন করছি।
-চে
(‘চে গুয়েভারা রিডার : রাইটিংস অন পলিটিক্স
অ্যান্ড রেভ্যুলেশন’,
অবলম্বনে ইংরেজি থেকে অনুদিত)।- তথ্যসূত্র:
ওয়েবসাইট।
Comments
Post a Comment