কয়েকদিন আগে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে
বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক— রশিদ হায়দারের একটি
সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। তিনি আমাদের জানালেন যে, তাঁর মায়ের
পড়াশোনা ছিল মাত্র তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। কিন্তু ওই যৎসামান্য
পড়াশোনার এত তেজ ছিল যে, অবসর পেলেই শরত্চন্দ্র
থেকে শুরু করে বড় বড় সব লেখকের উপন্যাস তিনি
পড়তেন নিবিষ্ট চিত্তে। আজ রশিদ হায়দার তাঁর এই পরিণত বয়সে
ভেবে অবাক হন তাঁর মা শুধু তৃতীয় শ্রেণির পড়াশোনাকে
সম্বল করে কীভাবে এত উচ্চ মার্গের উপন্যাস পড়তেন
অকাতরে। শুধু রশিদ হায়দারের মা হবেন কেন, মাইকেল মধুসূদন
দত্ত থেকে শুরু করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শংকর, শ্যামল
গঙ্গোপাধ্যায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এরকম আরও অনেক
প্রখ্যাত লেখক-সাহিত্যিকের মায়েরা ছিলেন আন্ডার ম্যাট্রিক।
অর্থাৎ তাঁরা ম্যাট্রিকুলেশন পাসও করেননি। অথচ তাঁরা তাঁদের এই
স্বল্প পড়াশোনা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে এমন কোনো গল্প-
উপন্যাস নেই যে, পড়তেন না। মাইকেল মধুসূদন, সুনীল,
শংকর, শ্যামল, শরদিন্দু— এরা সবাই তাঁদের আত্মজীবনী কিংবা
স্মৃতিকথায় লিখে গেছেন যে, তাঁদের মায়েদের ওই নিবিষ্ট
বই পড়ার জন্যই তাঁরা জীবনে লেখক হতে পেরেছিলেন।
অর্থাৎ তাদের মায়েদের বই পড়া তাঁদের জীবনেও ব্যাপক
প্রভাব বিস্তার করেছিল। এই মায়েদের মধ্যে অবশ্য কিঞ্চিৎ
ব্যতিক্রম ছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশের মা কুসুমকুমারী
দেবী। তিনি ম্যাট্রিক পাস করে আইএ ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু
শেষ পর্যন্ত ইন্টারমিডিয়েট আর পাস করা হয়ে ওঠেনি তার।
কুসুমকুমারী দেবী কবিতা লিখতেন। তাঁর কবিতা লেখার হাতও
বেশ ভালো ছিল। তাঁর অনেক কবিতাই বিখ্যাত হয়েছিল।
সেগুলোর মধ্যে একটি কবিতা তো রীতিমতো মানুষের
মুখে মুখে ফেরে। কবিতাটির নাম- আদর্শ ছেলে।
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড়
হয়ে কাজে বড় হবে/মুখে হাসি, বুকে বল তেজে ভরা মন,
মানুষ হইতে হবে— এই তার পণ। কুসুমকুমারী দেবীর নিজের
ঔরসেই সে রকম একটি ছেলে জন্মেছিল তার নাম-
জীবনানন্দ দাশ। আমরা কমবেশি সবাই জানি কবি জীবনানন্দ বাংলা
ভাষার প্রধানতম কবিদের একজন।
কিন্তু দুঃখের বিষয় জিপিএ ফাইভ পেয়েও আজকাল অনেক
বিদ্যার্থী রবীন্দ্রনাথের একটি গল্পের নাম বলতে পারেন
না। পিথাগোরাস কে ছিলেন জানেন না। আমাদের পার্শ্ববর্তী
সার্কভুক্ত দেশ নেপালের রাজধানীর নাম বলতে পারেন না।
স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস কিংবা ভাষা দিবস সম্পর্কে নেই
তেমন কোনো সম্যক জ্ঞান। এটা যে জাতির জন্য কত বড়
লজ্জার বলে বোঝানো সম্ভব নয়। মাছরাঙা টিভি থেকে
প্রচারিত জিপিএ ফাইভ পাওয়া এসব ছাত্র-ছাত্রীর সাক্ষাৎকারটি
দেখে বিস্মিত, অবাক ও নির্বাক হয়েছিলাম আমি। একটি
ছেলেকে প্রশ্ন করা হলো আমি জিপিএ ফাইভ পেয়েছি এটি
ইংরেজিতে বলত দেখি। ছেলেটি উত্তর দিল আই-অ্যাম জিপিএ
ফাইভ। ছেলেটির ইংরেজি শুনে হাসব না কাঁদব ভেবে পেলাম
না। মনে পড়ে গেল যখন স্কুলে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আমি
একদিন জনৈক শিক্ষক পেছনের বেঞ্চের একজন
ছেলেকে প্রশ্ন করলেন। এই ছেলে এটার ইংরেজি কর
তো—আমার বাবার একটি কুকুর ছিল। ছেলেটি দাঁড়িয়ে গড় গড়
করে বলল- মাই ফাদার ওয়াজ এ ডগ। শিক্ষক বললেন- আরে
নির্বোধ থাম... থাম... তোর জন্মদাতা বাবাকে আর কুকুর বানাস
নে। একটি ছাত্র যে গ্রেডটি সে পাওয়ার জন্য যোগ্য নয়
অথচ তার হাতেই কিনা আজ তুলে দেওয়া হচ্ছে সেই অমূল্য
সার্টিফিকেটটি। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী একজন সুশিক্ষিত মানুষ।
তিনি নিজেও সাত আটটির মতো বই লিখেছেন বিভিন্ন বিষয়ে।
অথচ তার মতো একজন মানুষ কেন যে এমন একটি
আত্মঘাতী পথ বেছে নিলেন এটা শুধু আমি কেন
অনেকেরই বোধগম্য নয়। যখন দেশের লাখ লাখ
শিক্ষার্থী রাজনীতির শিকার হয়ে তাদের ভবিষ্যৎ
অন্ধকারাচ্ছন্নময় ও তমশার তিমিরে নিমজ্জিত এরকম একটি
পরিস্থিতিতে তাদের করণীয় কী হতে পারে, এ প্রসঙ্গটি
কিন্তু অনিবার্যভাবেই সামনে চলে আসে। উদ্ভূত পরিস্থিতির
প্রেক্ষাপটে আমার নিজস্ব কিছু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আছে।
তিনটি স্তর অতিক্রমের মধ্যদিয়ে সাধারণত একটি ছাত্র
ক্রমান্বয়ে সুশিক্ষিত হয়ে ওঠে। একটি শিশু জন্মের পর
প্রথমত, সে শিশুটির প্রতি পিতা-মাতার একটি প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকে
শিশুটি কীভাবে গড়ে উঠবে। দ্বিতীয়ত, যখন সেই শিশুটি
আরও একটু বড় হয়ে বিদ্যালয়ে গমন করতে শুরু করে তখন
তার বেড়ে ওঠার পেছনে একটি মুখ্য ভূমিকা রাখে বিদ্যালয়ের
শিক্ষক-শিক্ষিকারা এবং তৃতীয়ত, একটি ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
একটি শিক্ষার্থীকে দেয় একটি সুশিক্ষার পরিবেশ। একটি শিশু
তার জীবনের প্রথম পাঠটি সে পায় তার পিতা-মাতার কাছ থেকে।
এখানে উল্লেখ্য, মাইকেল মধুসূদন দত্ত যখন ছোট ছিলেন
তখন তাঁর মা জাহ্নবী দেবী পুত্রকে কাছে বসিয়ে রামায়ণ-
মহাভারত পড়ে শোনাতেন। মধুসূদনের পিতা রাজনারায়ণ দত্ত
আরবি-ফারসি শেখার জন্যও একজন মৌলভী ঠিক করে
দিয়েছিলেন। মাইকেল মধুসূদন সেই মৌলভীর কাছ থেকে
উত্তমরূপে আরবি-ফারসি তো শিখেছিলেনই উপরন্তু
জীবনের অনেক শিক্ষাই তিনি অর্জন করেছিলেন সেই
মৌলভীর কাছ থেকে। কবি জীবনানন্দ দাশের মা কুসুমকুমারী
দেবী রাতের আহার্য পর্ব শেষে গৃহস্থালির সব কর্ম
সম্পাদন করে যখন শোবার ঘরে আসতেন তখন তিনি প্রায়ই
লক্ষ্য করতেন ছোট জীবনানন্দ তখনো জেগে। বিছানায়
মায়ের প্রতীক্ষায়। মায়ের মুখ থেকে কোনো না
কোনো গল্প কিংবা কবিতা শুনে তারপর সে ঘুমাবে, তার আগে
নয়। প্রাচীনকালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু ছিল শুধু রাজা,
রাজ আমাত্য ও আমির ওমরাওদের সন্তান-সন্ততিদের জন্য।
খ্রিস্টের জন্মের পাঁচ হাজার বছর আগে মিসরীয় ফারাও সভ্যতা
থেকে শুরু করে সক্রেটিস কিংবা প্লেটোর একাডেমি সব
জায়গায় ছাত্র হিসেবে পড়ানো হতো সাধারণত অবস্থাপন্ন
ঘরের ছেলেদের। অন্যদিকে সাধারণ ও গরিব ঘরের
ছেলেমেয়েদের শিক্ষা নিতে হতো তাদের বাবা-মায়ের
কাছ থেকেই। ছোটবেলায় পিতা-মাতার কাছ থেকে গল্প
শোনার মধ্যদিয়ে তারা সমৃদ্ধ হতো- জ্ঞানে, মূল্যবোধ
জাতীয় সূক্ষ্ম বিষয়গুলোতে সেই সঙ্গে তারা অর্জন করত
নানা বিষয়ে দক্ষতা। অন্যদিকে শিক্ষালয়ে একজন প্রকৃত
শিক্ষকই একজন ছাত্রের শূন্যতা পূর্ণ করে তাকে প্রকৃত মানুষ
হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। বাংলাদেশে শিক্ষকচরিত্রের
সর্বোত্তম আদর্শ বিদ্যাসাগর— সে কি শুধু তাঁর অধ্যাপনার
কৃতিত্বগুণে? তিনি সংস্কৃত কলেজে মেঘদূত কুমারসম্ভব
পড়াতেন, না পাণিনির ব্যাকরণ পড়াতেন, সে খবর নিয়ে আজ
কে মাথা ঘামায়? প্রতিদিনের বাক্যে, কর্মে, চিন্তায় তিনি যে
মহান ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিয়েছেন তাতেই তাঁর
শিক্ষকজীবনের পূর্ণ মহিমা প্রকাশ পেয়েছে।’
শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে ছাত্রের চিত্ত উদ্বোধন। অথচ
কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের একটি টিভি চ্যানেলে দেখলাম
ঢাকার একটি স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকারা কীভাবে ছাত্র-
ছাত্রীদের নকলের মতো ঘৃণিত চৌর্যবৃত্তিতে সহায়তা
করছেন। শিক্ষক-শিক্ষিকারা টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা দেখে
দৌড়ে শ্রেণিকক্ষে ঢুকে ছাত্র-ছাত্রীদের সাবধান করে
দিচ্ছিলেন যে, তাদের এই কুকর্মগুলো ধারণ করতে ছুটে
আসছে গণমাধ্যমের সাংবাদিক। তারপরও ক্যামেরায় ধরা পড়ল
তাদের সমবায় পদ্ধতিতে পরীক্ষা দেওয়ার সচিত্র কর্মকাণ্ড।
কোনো সভ্য দেশে এরকম শিক্ষক-শিক্ষিকা থাকতে পারে
এটি কারও চিন্তারও অতীত। অনেক বাবা-মা আবার তাদের
আত্মজদের নিয়ে সারাদিন ছোটাছুটি করেন বিভিন্ন কোচিং
সেন্টারে। কীভাবে শর্টকাট পদ্ধতিতে যে কোনো
মূল্যে তাদের ছেলে-মেয়েদের জন্য ছিনিয়ে আনা যায়
একটি জিপিএ ফাইভ। এই বিষয়ে প্রখ্যাত রসায়ন বিজ্ঞানী,
শিক্ষাবিদ ও লেখক প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের কিছু কথা মনে পড়ে
গেল। তিনি তার বাঙালির ভবিষ্যৎ নামক একটি প্রবন্ধে লিখেছেন-
‘আমরা বাল্যকাল হইতেই উপরচালাকি বা ফাঁকিদারি দ্বারা কাজ ফতে
করিতে চাই। রীতিমতো পরিশ্রম করিয়া বিদ্যার্জন করা যেন
রেওয়াজের বাইরে। কোন শিক্ষক বা অধ্যাপক যদি একটু বেশি
রকমের ব্যাখ্যা করেন, তাহা হইলে ছেলেরা অধৈর্য হইয়া
উঠে এবং সে অধ্যাপক অপ্রিয় বা ছাত্রদের বিরাগভাজন হইয়া
উঠেন। যে শিক্ষক যত নোট দিতে পারেন তিনি ছাত্রসমাজে
তত প্রশংসার ভাজন হয়। এইরূপে গোড়াতেই কাঁচা থাকার দরুণ
প্রকৃত শিক্ষা হয় না।’ অথচ একটি শিক্ষকের প্রধান কাজ হওয়া উচিত
নিরন্তর তার ছাত্র-ছাত্রীদের অন্তর্নিহিত পূর্ণতার বিকাশ সাধনে
সহায়তা করা। তিনি শিক্ষার্থীকে এমনভাবে দিকনির্দেশনা দেন
যাতে করে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে উত্তম চরিত্র তৈরি হয়,
মনে শক্তি বাড়ে, বুদ্ধির বিকাশ হয় এবং সেই সঙ্গে ছাত্রটি
নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়
সেই প্রাচীন গ্রিসে সক্রেটিস থেকে শুরু করে
প্লেটো, এরিস্টটল এঁরা সবাই তাঁদের ছাত্রদের এভাবেই
শিক্ষা প্রদান করতেন। সক্রেটিসের শিক্ষাদান পদ্ধতিটিও ছিল
বেশ অদ্ভুত। গ্রিসে এক সময় শুধু সক্রেটিসই নয় বরং তাঁর
সমসাময়িক দার্শনিকেরা সাধারণত হাঁটতে হাঁটতে ও চলতে চলতে
তাঁদের শিষ্যদের সঙ্গে আলাপচারিতার মাধ্যমে জ্ঞান বিতরণ
করতেন। সেই জন্য তাঁদের বলা হয় ‘পেরিপাটেটিক
ফিলোজফার’। আমরা একটু খেয়াল করলেই দেখতে পারব
আড়াই হাজার বছর আগে সক্রেটিস ও তাঁর সতীর্থ দার্শনিকেরা
হেঁটে হেঁটে জ্ঞান দানের যে সংস্কৃতি চালু করেছিলেন তা
কিন্তু স্বল্প পরিসরে আজও বিদ্যমান। কখনো কখনো দেখা
যায় কোনো গণমাধ্যম কর্মী যখন কোনো
বিশ্লেষকের সাক্ষাৎকার নেন তখন সেই সাংবাদিকটি
বিশ্লেষকের মুখের কাছে মাইক্রোফোনটি ধরে থাকেন
আর বিশ্লেষক হেঁটে হেঁটে সে সব প্রশ্নের উত্তর
দেন। সক্রেটিসের যোগ্য উত্তরসূরি ও শিষ্য প্লেটো
এথেন্সে যে শিক্ষালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার নাম
‘একাডেমি’। সেখানে একজন শিক্ষার্থীকে সবরকম শিক্ষাই
দেওয়া হতো- দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস প্রভৃতি পাঠ করার সঙ্গে
সঙ্গে একজন ছাত্রকে শিখতে হতো চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও
শরীরচর্চা প্রভৃতি বিষয়গুলো। আর তারই ধারাবাহিকতায় আজও
বেশিরভাগ স্কুলে এ বিষয়গুলো একটি ছাত্রকে বেশ গুরুত্ব
দিয়েই আয়ত্ত করতে হয়।
একটা সময় ছিল যখন একজন প্রথিতযশা শিক্ষকের সমাজে
অসামান্য কদর ছিল। এরিস্টটলের পিতা নিকোমাচাস ছিলেন
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের পিতা দ্বিতীয় ফিলিপের
রাজদরবারের চিকিৎসক। দার্শনিক প্লেটোর তখন চারদিকে
বেশ নামডাক। তিনি এরিস্টটলকে পাঠালেন প্লেটোর
‘একাডেমিতে’। কিন্তু কিছুদিন পর এরিস্টটলের বাবা যখন মারা যান
তখন টাকা-পয়সার অভাবে এরিস্টটলের পড়ালেখা সাঙ্গ হওয়ার
মতো জোগাড় হয়। পরিবারের এই বিপদে এগিয়ে এলেন
এরিস্টটলের চাচা, তিনি যাবতীয় খরচ দিতে রাজি হলেন। কারণ
একটাই, এরিস্টটলের পিতার স্বপ্ন ছিল এরিস্টটল প্লেটোর
একাডেমিতে পড়ালেখা শিখে কৃত্যবিদ্য হবে। প্রাচীনকালে
কনফুসিয়াস, ইবনে সিনা, আল বেরুনিদের মতো দার্শনিকদের
পেছনে ছাত্রদের লাইন পড়ে যেত যে কোনো
উপায়ে তাদের শিক্ষক হিসেবে পাওয়া যায় কিনা। রোমান সম্রাট
কালিগুলা সিংহাসনের লোভে আপন ভগ্নিপতিকে হত্যা করে তার
বোন ও ভাগ্নে নিরোকে নির্বাসনে পাঠানোর নির্দেশ
দেন। ক্যালিগুলার বোন কালিগুলার কাছে নিবেদন করে বলেন
— আমাকে ও আমার ছেলেকে নির্বাসনে পাঠাচ্ছ ভালো
কথা, পাঠাও। কিন্তু নিরোর শিক্ষক হিসেবে দার্শনিক
সেনেকাকে দয়া করে নিযুক্ত করে দাও। তোমার কাছে
এটাই আমার শেষ চাওয়া। ক্যালিগুলা তার বোনের কথা
রেখেছিলেন। তিনি নিরোর জন্য সেই সময়কার সর্বশ্রেষ্ঠ
দার্শনিক সেনেকাকে ঠিকই নিযুক্ত করে দিয়েছিলেন। সম্রাট
নিরো সম্পর্কে অনেক অপপ্রচার থাকলেও সঠিক ইতিহাস পাঠ
করলে জানা যায় কতটা প্রজাবান্ধব, দয়ালু ও ভালো শাসক ছিলেন
সম্রাট নিরো।
নব্বইয়ের দশকে আমরা যখন স্কুল-কলেজের ছাত্র ছিলাম
তখনো শিক্ষালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিরাজ করত একটি
সুস্থ প্রতিযোগিতার আবহ। বেশি বেশি পড়াশোনা করে কে
কাকে ডিঙিয়ে ফার্স্ট হবে এই ছিল আমাদের ধ্যান জ্ঞান।
প্রতিযোগিতা না থাকলে পড়াশোনা করে মজা কোথায়।
স্কুলে কিংবা পাড়া-মহল্লার ছেলেদের সঙ্গে বাংলা বানান নিয়ে
প্রায়ই মজার খেলা খেলতাম আমরা। একজন আরেকজনকে
কঠিন কঠিন বাংলা বানান জিজ্ঞাসা করে নাস্তানাবুদ করে দেওয়াই ছিল
এই ধরনের খেলার অন্তর্ভুক্ত একটি বিষয়। বাংলা বানানে ওস্তাদ
হয়ে ওঠাটা কাজে লেগেছিল কলেজে এসে। ঢাকা
কলেজে প্রথম দিনই বাংলা শিক্ষিকা আমাদের ত্রিশটির মতো
বানান লিখতে দিলেন। আমার এখনো মনে আছে ক্লাসের
দুই-আড়াইশ ছাত্রের মধ্যে সাতাশটি বানান সঠিক লিখে ফার্স্ট
হয়েছিল শাহেদুর রহমান সুমন। পরবর্তীতে সুমন ঢাকা
বোর্ডে সপ্তম হয়েছিল। দ্বিতীয় হয়েছিল কবি মহাদেব
সাহার ছেলে তীর্থ সাহা। তীর্থ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার
সুযোগ না পেয়ে কলকাতার স্কটিস চার্চে চলে যায় পড়তে।
তৃতীয় হয়েছিল আমার খুব কাছের বন্ধু সুহৃদ মোহাম্মদ এহসান,
ওর পঁচিশটির মতো বানান সঠিক হয়েছিল। এহসান ছিল দুর্দান্ত
মেধাবী ছাত্র। দুই-চার নাম্বারের জন্য মেধা তালিকায় জায়গা
করে না নিলেও লোক প্রশাসন বিষয়টিতে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ তে প্রথম বিভাগে প্রথম হয় এবং প্রায়
এক দশক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে এখন কানাডার ডালহৌসি
বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক প্রশাসন বিষয়ে অধ্যাপনায় নিযুক্ত। পাশাপাশি
কানাডার লেবার পার্টির সঙ্গে যুক্ত। যাই হোক আমি হয়েছিলাম
চতুর্থ। আমি সঠিক বানান লিখতে পেরেছিলাম চব্বিশটি। দীর্ঘদিন
বিদেশে পড়াশোনা করার ফলে ভালো বাংলা বানান জানি— এ কথাটি
এখন আর জোর গলায় বলতে পারি না। ছোটবেলায় স্কুলে
প্রমথ চৌধুরীর বই পড়া নামে একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম।
সেখানে তিনি বলেছেন- ‘সুশিক্ষিত লোক মাত্রেই
স্বশিক্ষিত’। প্রমথ চৌধুরীর কথাটি যে কতটা সত্য সেটি উপলব্ধি
করেছিলাম ঢাকা কলেজে পড়তে এসে। আমার সতীর্থ
বন্ধুদের দেখেছি কত রকম বই পড়ায় যে তাদের আগ্রহ।
গল্প-উপন্যাস, ইতিহাস, দর্শন সমাজতত্ত্ববিষয়ক বইগুলো আমরা
পড়তাম পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে। আমি একটি বিষয় লক্ষ্য
করেছি যে, পাঠ্যবইয়ের বাইরের বইগুলোও প্রকারান্তরে
পাঠ্যবইয়ের পড়াশোনাকেই সমৃদ্ধ করে। এ জন্যই সম্ভবত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর শিক্ষার হেরফের প্রবন্ধে
বলেছেন- ‘অত্যাবশ্যক শিক্ষার সহিত স্বাধীন পাঠ না মিশাইলে
ছেলে ভালো করিয়া মানুষ হইতে পারে না- বয়ঃপ্রাপ্ত হইলেও
বুদ্ধিবৃত্তি সম্বন্ধে সে অনেকটা পরিমাণে বালক থাকিয়া যায়।
বাল্যকাল হইতে আমাদের শিক্ষার সহিত আনন্দ নাই। কেবল যাহা
কিছু নিতান্ত আবশ্যক তাহাই কণ্ঠস্থ। তেমন করিয়া
কোনোমতে কাজ চলে মাত্র, কিন্তু বিকাশ লাভ হয় না’।
posted by:www.ojanakhobor.blogspot.com
Comments
Post a Comment